সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে জীবনের জন্মক্ষণও প্রাধান্য পাচ্ছে। কারণ তাতে রয়েছে ব্যক্তি মানুষের সারা জীবনের হিসেব-নিকেষ। তাইতো আপন জন্মরহস্যে মানুষ এত তৎপর। সৃষ্টির বিচিত্র নিয়মে পৃথিবীতে কেউ জন্মায় সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে আবার কেউ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে, অবাঞ্ছিত জীবনের ভীক্ষার সেই শূন্য ঝুলি পূর্ণ হয় সারা জীবনের নিষ্ঠুর নির্মম আর বঞ্চনার অভিজ্ঞতায়। যেন জন্মই তার আজন্ম পাপ। সেই পাপকেই সাক্ষী করে পার্থিব বিচারকের কাঠ গড়ায় তাকে অভিযুক্ত করা হয় জন্মের দায়ে। সভ্য সমাজের দেওয়া এই নির্মম শাস্তি তাকে আমৃত্যু বহন করে যেতে হয় নীরবে-নিঃশব্দে। আকাশ তাদের মধ্যে একজন। নিছক অর্থে তার কোনো জন্ম পরিচয় নেই। তবু সে বড় হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম জন্মঠিঁকুজি নিয়ে। কিন্তু এই অরফান চাইল্ড কেয়ারিং হোম-ই তাকে দিয়েছে সেই স্বপ্নের সোপান, জীবনের ঠিকানা। নির্দেশিত সেই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে কর্মজীবনে আজ সে প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী। কিন্তু এই পথযাত্রা খুব সহজ ছিল না। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তাকে দিতে হয়েছে জন্মের নগ্ন পরীক্ষা। তবুও সে থেমে থাকে নি। সমস্ত কষ্ট পাথরচাপা দিয়ে সে এগিয়ে গেছে। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় সাফল্য আসে মেধা আর একাগ্রতার জোরে কিন্তু হৃদয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে কতটা মেধার প্রয়োজন তা আকাশের জানা নেই বলেই তাকে হারাতে হয়েছে তার একমাত্র ভালোবাসা সুজানাকে। সততা আর নিষ্ঠায় বড় কোম্পানির চাকরির সুবিধার্থে তুলনামূলক অল্প সময়ে তার বাড়ি গাড়ি সবই হয়েছে। জীবিকার প্রয়োজনে সেসব মূল্যবান হলেও জীবনের প্রয়োজনে আকাশের কাছে নেহায়েৎই গুরুত্বহীন। সময়ের সাথে সাথে পার্থিব সামগ্রিক ভাবনায় ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ এখন তার কাছে নেহায়েৎ তুচ্ছ হলেও মাঝে মাঝে এই মন বড় অস্থির হয়। দুঃসহ অভিযাত্রার মতো এই পৃথিবীটাকে তার বেশ অপরিচিত লাগে। কেবলই মনে হয় এই পৃথিবী তাদের না, শুধু সাম্রাজ্যের মুকুট নিয়ে জন্মানো সেই ভাগ্যবানদের জন্য। কখনো যদি কোন বাসযোগ্য গ্রহ কিংবা নক্ষত্র মানবিক আবহে উদ্ভাসিত হয় তবে সেটাই হবে তাদের একমাত্র ঠিকানা। সেখানে তারা বাঁচবে শুধু মানবিক অধিকারে, জন্ম-পরিচয়হীন অস্পৃশ্যের মতো নয়। কর্মময় জীবনের ব্যস্ততার অবসরে দু’একদিনের ছুটিতে আকাশ এসেছে তার প্রিয় প্রাঙ্গণে। জীবনের বাস্তবিক বিবেচনায় এটাই তার ঠিকানা। এখানেই মিলেছে তার সত্যিকারের মানবিক পরিচয়। ভালোবাসা বঞ্চিত এসব শিশুদের সান্নিধ্যে বুক ভরা নিঃশ্বাসে নিজেকে খুঁজে পায় সে। প্রতীক্ষিত যাত্রার মতো বড় গেইট পেরিয়ে গাড়ি যখন ভেতরে ঢুকলো তখন একে একে খালারা দৌড়িয়ে এলো। প্রত্যেকের মুখে উচ্ছলতার হাসি। এই আঙিনায় এখন তার অনেক কদর। কুশল-মঙ্গল বিনিময় হলো সবার সাথে। গাড়িভর্তি খাবার।
আকাশের নির্দেশে সমস্ত প্যাকেটজাত খাবারসহ মিষ্টি-ফলফলাদি তুলে দিল খালাদের হাতে। এরাও সযত্ন সতর্কতায় এসব নিয়ে গেল কিচেনে। কারণ প্রত্যেকের এই হিসেবী খাবার থেকে কাউকে এতোটুকু বঞ্চিত করা যাবে না তার দৃষ্টি এড়িয়ে। তাছাড়া বিপদে-আপদে বর্তমানে সেই একমাত্র ত্রাণকর্তা। আকাশের উপস্থিতিতে এই দু’একদিন তাদের বেশ সংযত হতে হবে। কারণ এই ছাত্রদের প্রতি কোনো রকম অন্যায় সে সহ্য করতে পারে না। বেশিরভাগ সময়ই এদের সাথে কাটাবে বিধায় একটা ভয় থেকেই যায়। যদিও তার আসার খবরে গতকাল থেকেই ছাত্রদের ভুলিয়ে রাখার একটা চেষ্টা চলছে সবার দিক থেকে। আকাশ আসবে বলে কথা! খালারা চলে যাবার পর আস্তে আস্তে সেই মানুষটির কক্ষে ঢুকলো, যে তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, উপরে উঠার মই দিয়েছে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে যেমন সাহায্য করেছে তেমনি পরীক্ষা দিতেও নিয়ে গেছেন ঢাকা শহরে। তারপর যখন বুয়েটে চান্স পেল তখন ভর্তিসহ দু-তিন মাস পড়ার খরচ তিনিই চালিয়েছেন ব্যক্তিগত সুখ বিসর্জন দিয়ে। যদিও আর তাকে খরচ পাঠাতে হয়নি। আকাশ নিজের উপার্জনে বাকি পড়াশুনা শেষ করলেও এই মানুষটির ভরসার হাত তার সারা জীবনের জন্যেই রয়েছে। সেই মানুষটি হলেন হুমায়ূন স্যার। এখানকার সুপার। অতি সৎ-সজ্জন ব্যাক্তি। কিন্তু তাকে ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু অসৎ ব্যক্তি। যার ফলে নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে তিনি কোন কাজই করতে পারেন না। তবুও তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নিষ্ঠার ফলে এই অনাথ হোমের উন্নতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই স্যারের রুমে ঢুকে পায়ে ধরে সালাম করতেই তিনি মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।
“এভাবেই সারাজীবন মানবিক হয়ে বেঁচে থেকো।”
“দোয়া করবেন স্যার।”
“কখন এলে?”
“এইমাত্র”
তারপর কিছুক্ষণ কথা হলো। এবার ঘরের চাবি দিয়ে স্যার বললেন, “ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নাও, রাতে কথা হবে।”
“জ্বী।” বলে চাবি নিয়ে ঘরে গেল সে। এখানে এলে স্যারের কাছেই থাকে। স্যারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হওয়ায় তিনি সবকিছু অনায়াসেই শেয়ার করেন আকাশের সাথে। বছরখানেক হলো এখানে টিনের ঘরের কোয়ার্টার ভেঙ্গে দালানকোঠা হয়েছে। স্যার বিয়ে করেন নি। কিন্তু খুবই গোছানো। উন্নত সংস্কৃতিমনা এই মানুষটি এখানকার সবাইকে মানবিক শিক্ষা দিতে সারাজীবন আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই উন্নত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশে তিনি ঘরটাও সাজিয়েছেন কম দামের রুচিসম্পন্ন জিনিসপত্রে।
একটা লাগোয়া বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে আকাশ লক্ষ্য করলো, তার জন্য নতুন গামছা রাখা হয়েছে এবং বাথরুম একবারে ঝকঝকে তকতকে। স্যারের সবকিছুতেই খুব খেয়াল। শাওয়ার ছেড়ে গোসল করতে গিয়ে এক বিকেলে সহপাঠীদের প্ররোচনায় বৃষ্টি ভেজার অপরাধে হল সুপারের প্রচন্ড মারের সেই অনুভূতি ফিরে পেয়ে খুব ভালো লাগলো তার। এখানে এলে অতি তুচ্ছ ঘটনাও বারবার অতীতে নিয়ে যায় তাকে। অথচ ঢাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে অত্যাধুনিক বাথরুম তাকে কখনো এই মুহুর্তের মধুমাখা অনুভবে নিয়ে যেতে পারে নি। এই আঙ্গিনার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে তার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনে পদার্পণ। সেসব যতই নির্মম হোক তবু স্মৃতি বড় মধুর। গোসল সেরে বেড়োনোর সাথে সাথে খাবার নিয়ে আমেনা খালা, নিশি খালার প্রবেশ। গতবার এদের সাথে নিরু খালাও ছিল। কিন্তু আজ আর তিনি নেই। এক বছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তাকে বাঁচাতে সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে আকাশ। বড় ডাক্তার, বড় হাসপাতাল, উন্নত মানের চিকিৎসা সবকিছুই হার মেনে গেল এই মরণব্যাধির কাছে। নিরু খালার কাছে সে আমৃত্যু ঋণী থাকবে। যে মা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেও দায়িত্বের বোঝা নামাতে আলো-আঁধারে এক সন্ধ্যায় তাকে ঝোঁপের আড়ালে রেখে গিয়েছিল, অবোধ শিশুর ক্রন্দনেও সেই মা পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে পথ দিয়ে যাবার সময় ক্রন্দনরত এই শিশুকে দেখে অবিবাহিত নিরু খালার সহজাত মাতৃহৃদয় জেগে উঠায় ফেলে যেতে পারেনি দৃঢ় মানবিকতায়। সমাজের কঠিন নিয়মকে তিনি উপেক্ষা করে সেই শিশুটিকে সেদিন প্রাণে বাঁচাতে নিয়ে এসেছিল ভাই-বোনদের যৌথ সংসারে। কিন্তু এই বিষয়টাকে কেউ ভালোভাবে নিতে পারেনি বিধায় এক সময় শিশু সদনে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সুযোগ পেলেই সে বাচ্চাটিকে একনজর দেখার জন্য মরিয়া হতেন তিনি। যখন সে শিশুটির পাঁচ বছর হলো তখন তিনিই এনে দিয়েছিল এই অনাথ হোমে। যাকে বলা হয় এতিমখানা। এই সে এতিমখানা। নিরু খালা, যিনি জন্ম না দিয়েও আকাশের মা। এইখানে তিনি কাজ করতেন। সেই সুবাদে যতোটুকু পেরেছে সন্তান বাৎসল্যে ততটুকুই চোখে চোখে রেখেছেন আকাশকে। একটা অদৃশ্য ভরসার হাত সব সময় ছিল আকাশের মাথার উপর। এই মুহূর্তে নিরু খালাকে খুব মনে পড়ছে। আকাশের অন্যমনস্কতায় আমেনা খালা বললো,
“কি ভাবছিস, বেলা যে পড়ে এলো, খেতে আয়। ক্ষুধায় যে মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে।“
“আসছি” বলে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে দেখল সেখানে তার সব পছন্দের খাবার। সেইসাথে পাত্র ভরা মুরগির গোশত। এই খাবারগুলো ব্যক্তিগতভাবে তার জন্যই রান্না করা হয়েছে। গল্পে গল্পে আমেনা খালার আন্তরিক পরিবেশনায় খেতে খুব ভাল লাগছে তার। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক সমীহপনা থেকে এই আন্তরিকতা তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাইতো সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসে। সুস্বাদু ভর্তা খাবার পর যখন বেশ কয়েকটা টুকরো গোশত পড়লো তার পাতে তখন সেদিনের জ্বলজ্বলে স্মৃতি স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠলো মনের আয়নায়। তখন সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে আকাশ। হঠাৎ করে একদিন জ্বর এলো। স্বাভাবিক জ্বর ভেবে প্যারাসিটামল খেলো বটে কিন্তু জ্বর কমলো না। দিনকে দিন জ্বরের প্রকোপ বেড়ে চলল। এবার ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিকের সাত দিনের কোর্স শেষ করলেও ভালো হতে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক লেগে গেল। শরীর খুব দুর্বল। ডিউটিকালীন সময়ে নীরু খালা প্রতিবেলায় শারীরিক খোঁজ নিত। সেই সাথে বাইরের কিছু শুকনো খাবার কিনেও দিতো। জ্বর সেরে গেলেও খাবারের রুচি একেবারে চলে গিয়েছিল। যদিও সুজানাদের বাড়ি থেকে এটা সেটা রান্না করে পাঠাতো। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করতো না। অ্যান্টিবায়োটিক এর জন্য পর্যাপ্ত খাবার এর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও নিরু খালার কিনে দেওয়া পাউরুটি আর জ্বাল করা সাগুতেই প্রাণরক্ষা পেয়েছিল সেই যাত্রায়। স্যাররাও অসুখে তার প্রতি যথেষ্ট যত্নবান ছিল। কারণ সেই ছোটবেলা থেকেই মেধা আর পড়াশোনার প্রতি একাগ্রতায় প্রত্যেক শিক্ষকদের স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল সে। তাইতো তার প্রতি কয়েকজন স্যারের এক পেশে নজর কারোর কারোর বিড়াগভাজন হতে হয়েছিল তাকে। ক’দিনের জ্বরে বড় ভাইদের ভাতৃসুলভ যত্নে যতটা না পারিবারিক বন্ধনের স্বাদ অনুভব করেছিল তার থেকে অনেক সুখানন্দ পেয়েছিল এখানকার সবচেয়ে বদমেজাজী ছেলে শফিক ভাইয়ের সেদিনকার আন্তরিক সাড়ায়। জীবনের রুক্ষতায় সুন্দর মনের স্পর্শগুলো হারিয়ে যেতে যেতে কাঠিন্যের প্রলেপে এদের বেশিরভাগই হয়ে উঠে বাস্তব বির্বজীত, বদমেজাজি এবং অসামাজিক। কিন্তু আবরণ ভেদ করা সেই স্বচ্ছ হৃদয়ের প্রকাশও ঘটে কখনো কখনো। সেদিন শফিক ভাইয়ের এতদিনকার চাপাপড়া সেই সুন্দর মনের আভাস পেয়ে খুব ভাল লেগেছিল আকাশের। জ্বর সেরে গেলেও হঠাৎ করেই মাথায় তীব্র যন্ত্রনা অনুভূত হলো। সবাই স্কুলে চলে গেছে। রুমে সে একা বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আজ ঔষধও খাওয়া হয়নি। এমন সময় শফিক ভাই তার রুমে এসে এই অবস্থায় তাকে দেখেও নিষ্ঠুরের মতো চলে গেল। হঠাৎ অকারণে অভিমানী হয়ে খুব কান্না পেল তার। ব্যথার যন্ত্রনা, অভিমানী কষ্ট এক হয়ে অশ্রু জলে ভিজে গেল তার বালিশ। অথচ শফিকের কাছ থেকে এই নির্দয় ব্যবহারই অনেক স্বাভাবিক। তবু কেন এত প্রত্যাশা! এবার রাগ হলো নিজের উপর। পিছন ফিরে শুয়ে কাঁদতে লাগলো। হঠাৎ স্নেহময় হাতের স্পর্শে পিছন ফিরে ভীষণ অবাক হল আকাশ। “জ্বর আছে এখনো, ঔষধ খেয়েছিস?” শফিক ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে বলল সে “না।”
“কে তোকে ওষুধ খাইয়ে দিবে?” চুপ করে রইল সে। কথার রূঢ়তার মাঝেও তার ভালবাসা প্রকাশ পেল। এতক্ষণের অভিমানী কান্না ভুলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শফিক ভাইয়ের দিকে। প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে ঔষধ খাইয়ে কপালে জলপট্টি দিয়ে পাশের টুলে এক জগ পানি রেখে দিল। যাবার সময় বলে গেলো, “জ্বর, মাথাব্যাথা না কমলে পাশের রুমে খবর দিস।” এতোটুকু ভালোবাসার যত্নে আকাশের মন ভরে গেল। এই তাগিদ অন্য কিছু নয়, শুধুই ভালবাসার। অনাদরে অবহেলায় যে জীবন গড়া সেই জীবনের ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত হবে কি করে? এভাবে সবার যত্নে ডাক্তারি চিকিৎসায় জ্বর সেরে গিয়েছিল। শরীর খুব দুর্বল। মুখে রুচি না থাকায় খেতেও ভালো লাগছিল না। কিন্তু পুরোপুরি জ্বর কমবার দু’একদিনের মধ্যে হঠাৎ একদিন কিচেনে সুস্বাদু রান্নার গন্ধে তার পেটপুরে গোশত দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করলো। নিচে নেমে গিয়ে আবারো ফিরে এলো। এখনো রান্না শেষ হয়নি। খাবার শুরু হতে আরো অনেকটা সময় বাকি। সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামার ঝোক্কিতে দুর্বল শরীরে রুমে এসে আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেলা বাড়তে লাগলো। স্কুল থেকে ফিরে ছাত্ররা দুপুরের খাবার সেরে প্রত্যেকে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যখন আকাশের ঘুম ভাঙলো তখন অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। ক্ষুধার তীব্রতা টের পেয়ে দুর্বল শরীরেও তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে কিচেনে গেল। পুরো কিচেন ফাঁকা। আমেনা খালাকে একাকী বসে থাকতে দেখে মনে মনে খুশি হলো ভেবে তার জন্য অন্তত কেউ অপেক্ষা করছে। খুশিমনে আকাশ ডাইনিং টেবিলে বসা মাত্রই আমেনা খালা দুই টুকরো আলুসহ গোশতের ঝোল আর গঙ্গার পানি ডালসহ থালা বেড়ে সামনে দিয়ে শারীরিক অবস্থা জানতে চাইল। মনে মনে হাসলো আকাশ। “কি হলো ভুলো মন আমেনা খালার। জ্বরের কথা শুনতে শুনতে গোশত দিতে ভুলে গেছে।” ভাতের থালা সামনে নিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো আকাশ। কিন্তু আমেনা খেলা তখনও বসে। এবার গোশতের কথা মনে করিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিতেই খালা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খানিকটা অনুনয়ের স্বরে বলল,
“বাবারে, আজ এগুলো দিয়েই খেয়ে নে। কয়েকদিন যাবৎ খালার মুখে একেবারেই স্বাদ নেই। তাইতো আজ গোশত দিয়ে পেটপুরে খেয়েছি আর দুই টুকরা নিয়ে যাব ছেলেটার জন্য। তুই মনে কিছু করিস না, আরেকদিন তোকে পুষিয়ে দেব।”
অন্যদিন এই আদুরে কথার জন্য নিঃশব্দে চলে যেত আকাশ। কিন্তু আজ রোগের অসারতা আর ক্ষুধার্ত পেটে তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। খালাকে কিছু না বলে ভাতের প্লেট খানা নিয়ে চট করে উঠে গেল। তার এই ক্রোধান্বিত চেহারায় খালা খানিকটা ভয় পেল। এই কথা কোন কারণে সুপারের কানে গেলে তার চাকরি টিকিয়ে রাখা ভার।
“এবারের মত ক্ষমা করে দে, বাজান। কাউকে কিছু বলিস না।”
প্রতিউত্তরহীনভাবে প্লেটের ভাতগুলো ড্রেনে ফেলামাত্র হাজার কাকের কোলাহলের ভীড়ে আকাশের রাগ খানিকটা চাপা পড়ে গেলেও আমেনা খালার বিদ্রুপাত্মক কথা স্পষ্ট শোনা গেল।
“এতিম পোলাগোর এত রাগ ভালো না।” সত্যিই যেন তাই। সরকারের দেয়া কিংবা মানুষের করুনায় যারা বেঁচে থাকে, জীবনের অলিখিত নিয়মে সেসব শেকড়হীন মানুষদের জন্য চাওয়া-পাওয়ার সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। সেটাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা এখনও অর্জিত হয়নি দাসপ্রথা কিংবা শ্রেণীসংগ্রামের সংকল্পের লড়াইয়ের যুক্তিকতায়। তাইতো জন্ম-লজ্জার গ্লানিকে জীবনও ক্ষমা করে না। সেই ক্ষমাহীন গ্লানিতে ক্ষুধার্ত পেটে সেদিন একাকী নির্জন পুকুরঘাটে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খুব কেঁদে ছিল আকাশ। কেউ জানলো না, কেউ শুনল না শিশুমনের সেই করুণ আর্তনাদ। সেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সেই আমেনা খালা আর আজকের আমেনা খালার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সেদিন এক টুকরো গোস্ত না পাবার অভিমানে যে ছেলেটি দুপুরের খাবার বর্জনেও এক মাতৃহৃদয় এতোটুকু কাপলো না। আজ তার পরিবেশনায় থালা ভরা গোশত আকাশের ভাবনার জগতে অন্য মাত্রা এনে দিল। হঠাৎ ভাবনায় ছেদ হলো আমেনা খালার কথায়,“রান্না ভালো হয়নি বুঝি?”
“এ কথা বললে কেন?”
“তুই শুধু নাড়াচাড়া করছিস্ কিছুই তো খাচ্চিস্ না!”
কথায় কথায় খাবার শেষ হওয়ায় খালা বলল,“আরেক টুকরো গোশত নিতে হবে তোকে।”
“না।”
সেদিনের সেসব দুঃখময় স্মৃতিতে গোশত গলা দিয়ে নামতে না চাইলেও অসীম ক্ষমায় খেয়ে নিল হাসিমুখে। হয়তো এটাই জীবনের বিচিত্রতা। বঞ্চিত জীবনে এই মুহূর্তে স্নেহটুকুই বা কম কিসের! সেদিনও হয়তো এমনই ছিল। জীবনের কঠিন দাবদাহে মনের কোণের স্নেহ-আদর স্পষ্ট ছিল না বলেই সবাইকে এক কাতারে ফেলে প্রতিশোধ-স্পৃহায় অনাথের আপন জ্বালা জুড়ায় নানাভাবে। তবু তো সে বেঁচেই ছিল, রাতের ঘুমটুকুর জন্য তাকে ভাবতে হয়নি। আরো ভাবতে হয়নি খাওয়া-পড়া ওষুধপত্র এমনকি পড়াশোনার জন্যও। পথকলিদের জীবন বিশ্লেষণে এই জীবন যেন সত্যিই প্রাচুর্য্যময়। কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলে বাঁধা ব্যক্তি স্বাধীনতা আর জন্মের ইতিহাস টুকুকে বাদ দিলে সাধারণ জীবন-যাপনের প্রায় সবটুকুই আছে এই আঙিনায়। এই সন্তানদের কারোর হয়তো মা-বাবা থেকেও নেই, কেউ অভাবের তাড়নায় মা-বাবার স্নেহাশীষ থেকে বঞ্চিত আবার কেউ যেন মূল উপরানো শেকড় হয়ে আছে। অর্থাৎ এই আঙ্গিনাকে ঘিরে আছে শুধুই বঞ্চনার ইতিহাস। প্রতি বছর সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর থেকে এদের উন্নতিকল্পে নানা পরিকল্পনা করা হয় কিন্তু তাদের নিগূঢ় মানসিক যন্ত্রণা অবসানে কোন কিছুই করা হয় না। যেন অভিশপ্ত জন্মক্ষণেই জীবনের নির্দয় পরিকল্পনা নিহিত। এখানকার আর দশজনের মতো তাকেও বড় হতে হয়েছিল আমেনা খালা, নিশি খালা, শিউলি খালা সন্দিগ্নু তদারুপিতে। শিক্ষক হল সুপার সবাইকে ডিঙিয়ে শাসনের নিরব স্পর্ধায় তাদের অলিখিত গুরুত্ব অনেক বেশি। খালাদের কাছে এসব ছাত্রদের অবস্থান মধ্যমাঠের বল খেলার মতোই। যখন যার কাছে যায় কর্তব্যবোধে সেই বল তারাও লুফে নেয়। জেতার নেশায় সেই বলকে পায়ে পায়ে এগিয়ে নিয়ে কোনো এক সময় গোলও করে। জয়ের আনন্দে তখন সবাই মাতোয়ারা হলেও বলের অন্তর্গত ক্ষতির কথা কেউ ভাবে না। জয়ই যেন আসল কথা। তেমনি কত ক্ষরণ, কত দহনের মাঝে আকাশ যখন আজ এই অবস্থানে, তখন কেউ তার ভেতরের দহন খুঁজে দেখে না। তার বর্তমান প্রতিষ্ঠাই সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বে আমেনা খালার অতি স্নেহের স্পর্শ পাওয়া গেল। সুখ-দুঃখের নানা কথায় খাবার শেষ হলো আকাশের। বরাবরের মতো সমস্যা সমাধানের আশ্বাস পেয়ে খালা চলে যাবার পর খানিকটা বিশ্রাম নিতে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সুজানাদের বাড়ির ছাদ। ওই বাড়িতে এখন আর কেউ থাকেনা। সুজনের মৃত্যুর পর এই বাড়ি ছেড়ে মা মেয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। আজ সুজন বেঁচে থাকলে তাদের সম্পর্কের মিলনে কোন সমস্যায়ই থাকতো না। সে খুব উন্নত মানসিকতার মানুষ ছিল। ছোটবেলার বন্ধুত্বের হাত ধরে এই পরিবারের সাথে অন্তরঙ্গতা ছিল আকাশের। সমবয়সী সুজনের আন্তরিক বন্ধুত্ব কলেজ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কোন এক বাস দুর্ঘটনায় সুজনের মৃত্যু হয়। তারপর অনেকদিন পর্যন্ত তার মা প্রায় পাগলের মত ছিল। সন্তান হারা এক মাকে শান্তনা দিতে মাহারা আরেক সন্তানের অবাধ যাতায়াতে আকাশের প্রতি আরও দুর্বল হয় সুজানা। সেই ছোটবেলা থেকে তার প্রতি অন্যরকম টান ছিল সুজানার। এখনো মনে আছে, একবার খেলতে গিয়ে ভাঙ্গা কাঁচে আকাশের পা কেটে অনেক রক্ত বের হলো। সেই রক্ত দেখে সুজানার সে কি কান্না! বাসায় গিয়ে মা সহ পুরো ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। তারপর রক্ত বন্ধ হবার পর কান্না থামল তার। প্রতি ঈদে মেয়ের বায়না রাখতে সুজনের মতোই ড্রেস কিনে দেওয়া হতো আকাশকেও। তাতে ভাই-বোন দুজনেই খুশি হত। ভালো কিছু রান্না হলেই সুজনদের বাসায় আকাশের ডাক পড়তো। কিন্তু আত্মসম্মানের জন্য সে যেতে না চাইলেও ভাই-বোন এসে তাকে জোর করে নিয়ে যেত। বিলাসী খাবারে তার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি স্থির হতো এক মা কীভাবে তার সন্তানকে ভাবে আদর করে কিংবা শাসন করে তা দেখে। তার অন্যমনস্কতার জন্য সুজানা বলতো, “ভাইয়ার মত তোমারও বুঝি আদর পেতে ইচ্ছে করে?”
লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে খেয়ে নিত আকাশ। রুমে ফিরতে বুকের মধ্যে তিরতিরে কষ্টের অনুভবে। কখনো বা চোখের জল ফেলতো নীরবে-নিঃশব্দে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সুজানের মাকে নিজের মা কল্পনা করে মনে মনে কত না কথা বলে যেত। আবার কখনো বাংলা সিনেমার আদলে কাল্পনিক গল্প সাজাত। সে গল্পে মা-বাবাসহ তার এক সুন্দর সংসার ছিল। কোনো এক কারণে সংসার নষ্ট হয়ে গুন্ডাদের হাতে বাবাকে মরতে হয়েছিল। তারপর তাকে ঝোঁপে ফেখে মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কোনো এক কারণে সে বেঁচে গিয়ে অন্য এক আশ্রয়ে বড় হয়েছে। তারপর একদিন মায়ের সাথে পরিচয় হয় তার। ছেলে চিনতে না পারলেও সন্তানের শরীরের গন্ধে মা ঠিকই চিনেছিল তাকে। তারপর মা ছেলের অনেক কান্নাকাটির পর সিনেমার মতো মিল হয় তাদের। এভাবে নানা কল্পনায় ঘুমিয়ে পড়ত সে। আকাশের কাছে সুজনদের বাড়ির প্রধান আকর্ষণ ছিল তার মা। তিনি আকাশকে ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। বড় হবার পর আকাশের প্রতি সুজানার অতি মনোযোগ প্রথমদিকের এক অনাথের প্রতি করুনা ভেবেই মা স্বাভাবিকতায় নিয়েছিলেন। কিন্তু স্বার্থের গ্রন্থিতে আটকে সেই ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। হয়তো জন্মের ঠিঁকুজিতেই ছিল তার এই ভবিতব্য। যৌবনের দ্বারপ্রান্তে এসে সুজানার ভালোবাসার দোলায় সাড়া দিতে ইচ্ছে হলেও জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় নিজেকে সামলে নিল। কারণ তেলে জলে কখনো মিশে না। নানা ছুঁতোয় সুজানাদের বাড়িতে আসা যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিল। অথচ বাস্তবিক পারিবারিক ভাবনা এই আঙিনা থেকেই তার মনে ধারণা হয়েছিল। এরা এই মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দা। তাইতো সুজানার মায়ের সাথে এখানকার স্টাফদের অনেক জানাশোনা ছিল। সেই সুবাধে তাদের অবাধ যাতায়াতে কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। সেই সাথে তাদের গুরুত্বে অন্যান্য ছাত্রদের তুলনায় আকাশের ব্যাপারে অনেকটা ছাড় ছিল। তার স্বভাব, চরিত্র এবং মেধা কে কেন্দ্র করে একটা আলাদা মূল্যায়ন ছিল এখানকার স্কুল শিক্ষকদের। প্রতি বিকেলে খেলার মাঠে সুজন যোগ দিতো তাদের সাথে। হাসি আনন্দে ভরে উঠত সেই প্রাঙ্গন। এই শিশুদের প্রাণোচ্ছলতা দেখে কে বলবে,এদের কেউ কেউ মানবদেহের সর্বোত্তম এন্টিবডি মাতৃদুগ্ধের স্বাদ কখনই পাইনি। আবার কারোর মা ডাকার সৌভাগ্যও হয়নি। এরা যেন সবাই অদৃশ্য কোন এক মায়ের সন্তান। যে মা আদরে সোহাগে বড় হিসেবী আর অনাদরে-অবহেলায় বেহিসেবী। এভাবে প্রতিদিনের অভ্যাসে অভ্যাসে তাদের শিখিয়ে দেয় এই জীবন এমনই দুঃসহ যন্ত্রণাময়।
সুজানাকে সে যতই এড়িয়ে চলুক না কেন, মন অজানা আকর্ষণে পড়ে থাকত তার কাছে। অসুন্দর পৃথিবীর এই নগ্ন নিয়ম ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন পৃথিবী গড়তে বড় সাধ হয়। কিন্তু পেরেকে গাঁথা সেই আকাশচুম্বী দেয়ালকে কেউ টপকাতে পারেনি। আকাশও পারবে না। এক বুক জ্বালা নিয়ে তার পূর্বসুরীদের মতো সেও ভেসে বেড়াবে জরা-যন্ত্রণার এই পৃথিবীতে। এই স্তম্ভিত সময় যেন চিরণন্তী ধারার বাহক। খুব ভালো রেজাল্ট করে আকাশ যখন বুয়েটে চান্স পেল তখন তার কৃতকার্যতা নির্লজ্জ আপন পরিচয়কে আরো দৃঢ়ভাবে সামনে আনল। করুনার চাদরে ঢাকা আকাশ অভিভাবক মহলেও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো। দয়া-দাক্ষিণ্যে ভরা নানা মানুষ এবার তাকে ভবিষ্যতের সম্পদ হিসেবে নিজের দখলে রাখার নানা ইচ্ছা পোষণ করলেও দয়াবান এই সুপার স্যারই তাকে আগলে রেখেছিল নিজের মনের সক্ষমতা দিয়ে। হলে এসে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে আকাশের সময় লাগলো না। কারণ যাদের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব খুব নগণ্য তারা সব জায়গায় মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়। ছিন্ন মুকুল হিসেবেই আকাশ সেখানে পরিচিত হল কোন রকম রাখ-ঢাকহীন ভাবে। তার কিছু ভালো বন্ধুও জুটলো। আবার কেউ কেউ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র হয়েও সূক্ষ কৌশলে তাকে আলাদা করতে ছাড়লো না। এই নির্মম আনন্দ তাদের সত্ত্বায় লুকিয়ে আছে। তাইতো আঘাতের এই খেলায় তারা আনন্দ-আগ্রহী। কিন্তু তখন এসব তুচ্ছ ভাবনার ঊর্ধ্বে সে। কাজেই তাকে পড়াশোনা করে অনেক বড় হয়ে প্রমাণ করতে হবে জন্মে নয় কর্মেই মানুষের আসল পরিচয়। বছর দুয়েক পর সুজানা ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেল। এবার সে আকাশকে কোনভাবেই ছাড়বার পাত্র নয়। তাকে চাই-ই তার। আকাশকে ছাড়া তার পৃথিবী অসম্পূর্ণ। নানা ছলা-কলায় সে আকাশকে চায়। কিন্তু কোনভাবেই তাকে জয় করতে না পেরে রাগে-অপমানে মনে হতো আকাশ হয়ত তার এ জন্মের মতোই নিষ্ঠুর অথবা অন্ধ স্বপ্নের মতো কঠিন। পাথরে গড়া একটা মন ছাড়া আর কিইবা আছে তার? না আছে জন্মপরিচয়, না আছে পারিবারিক বন্ধন। তবু কেন তার কাছে বারবার ছুটে যায় সে? দিনকে দিন আকাশকে পাবার ইচ্ছায় সুজানাকে বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেখে আকাশ বলেছিল,“ এই সুন্দর জীবনটাকে কেন ধ্বংস করতে চাও?”
“আমি তো ধ্বংস করতে চাই না গড়তে চাই।”
“গড়তে গিয়ে যে নিজেই হারিয়ে যাবে!”
“তবু তো সৃষ্টির আনন্দে মরবো।”
“রঙিন চোখে তুমি যাকে সৃষ্টি বলছো সে সৃষ্টি নয় শুধুই ধ্বংস।”
“তোমার কঠিন কথা আমি বুঝি না,আমি শুধু তোমাকে চাই।”
“এটা তোমার তারুণ্যের অহংকার, কঠিন বাস্তবের ঘায়ে যেদিন তোমার উচ্ছ্বাস ফুরিয়ে যাবে সেদিন এই আমাকেই নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলতে তোমার আভিজাত্যের সংস্কারে বাঁধবে না। মনে রেখো অসীম ভালোবাসা খানিকের ভালোলাগা ফুলের মতোই।
“একবার অন্তত ভালোবাসা প্রমাণের সুযোগ দাও।”
“যৌবনের উদ্দীপনায় তোমার এই ভাবনা আজকের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু যেদিন এই আবেগের নেশা কেটে গিয়ে বীভৎস বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াবে, সেদিন সামান্য ছুঁত ধরে এদেশের চার লক্ষ শেকড়হীন এই অসহায় অনাথ শিশুদের গায়ে কলঙ্ক লেপন করতে তোমার এতটুকুও বাধবে না। তুমি আমায় ভুলে যাও।”
“আমি পারবো না।”
“আমি তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না।”
“কেন?”
“হিংসা, আক্ষেপ আর অব্যক্ত যন্ত্রণায়।”
“তুমি কোনোদিন সংসার করবে না?”
“তা তো বলি নি।”
“কেমন মেয়ে তোমার প্রয়োজন?”
“আমার মতো সমব্যাথী কাউকে।”
“ও আচ্ছা।”
এভাবেই কথার পৃষ্ঠে কথা চলল অনেকক্ষণ। সুজানাকে কোনভাবেই তার জীবন থেকে সরানো যাচ্ছে না। তার এই জেদীপনা রুখতে হঠাৎ আকস্মিকভাবে আকাশের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “এখানে আর কোনদিন এসো না, আমাকে ভুলে যাও।”
অভাবনীয় বাক্যের বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো সুজানা। তারপর জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণায় অসাড় দেহটাকে নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো। অশ্রুকণা জমে গেল। অভিমানী কান্না ঘৃণার বিষ বাষ্পে পরিণত হল, প্রধের নিঃসরণ হলো স্বাজাত্যভীমানের অহংকারে। নিজেকে শান্ত করে বাড়ি ফিরে এলো বিসর্জনের এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে।
সুজানা চলে যাবার পর একটা অপরাধবোধ আকাশকে ঘিরে ফেলল অক্টোপাশের মতো। অদৃশ্য ধিক্কারে তার শরীর মন ছেয়ে গেল। ভেতর থেকে ঘৃণিত স্বরে কে যেন বলে উঠল,
“ছি! ছি! তুমি শুধু এক সামান্য নারীর কাছেই হেরে যাও নি। হেরে গেছ সমাজ, সংস্কার এমনকি মনুষ্যত্বের কাছে। যুদ্ধ ময়দানে হেরে যাওয়া সৈনিকের মতোই তুমি দুর্বল।” অস্থির পায়চারিতে জাগ্রত বিবেকের তাড়নায় মন আরো চঞ্চল হল। সে কি আক্ষরিক অর্থে সত্যিই শিক্ষিত? অবশ্যই নয়। কারণ যে শিক্ষা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেনা সেই কুশিক্ষা মানুষকে কলঙ্কিত করে। একটি মেয়ে সমাজ-সংস্কারকে তুচ্ছ করে জন্মপরিচয়হীন একটি ছেলেকে ভালোবেসে জীবনসঙ্গিনী করতে চেয়েছে। কিন্তু ছেলেটি ভবিষ্যতের বাস্তবিক ভাবনার তুচ্ছ অজুহাতে বড় নির্দয় ভাবে মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিয়েছে কাপুরুষের মতো। কিন্তু কেন? ছেলেটির ভয় কিসের! সমাজ না নিজের মনের অনুদার কাঠিন্যতা। তাহলে কে বদলাবে এ পৃথিবী! মানবিকতা না সময়? শিক্ষিত হবার মানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে বড় চাকুরি কিংবা বিত্ত-বৈভব নয়। প্রস্ফুটিত হৃদয়ই শিক্ষার সত্যিকারের ধারক ও বাহক। কাজেই শিক্ষার দায় থেকে এই ঘুনেধডরা সমাজকে কে বদলাবে? সমাজের নিষ্ঠুর প্রথার অঙ্কুর বিনাশে সুজানাকে ফিরিয়ে ঠাঁই দেবে এই হৃদয়ের বিশালতায়। অনুশোচনার তীব্র দহনে বিবেকের সাড়ায় আকাশ ফোন করল বেশ কয়েকবার। কিন্তু সাড়া মিলল না। এবার প্রায়শ্চিত্ত করতে আকাশ তার কাছে গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করল উদার মানসিকতায়। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঘর বাঁধার অঙ্গীকারে অভিমানী সুজানাকে স্বাভাবিক করল। পৃথিবীর সবচেয়ে মাধুর্য্যপূর্ণ শব্দের হৃদয় অনুরাগে সুজানা বলল,
“আজই আমার শেষ রাত ছিল।”
চমকে উঠল আকাশ। কোন এক ভালোবাসার হত্যাকারীকে সময় আজ বাঁচিয়ে দিল। সেই বাঁচার অঙ্গীকারে সুজানা তার হৃদয় গহীনে ভালোবাসার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে জায়গা করে নিল অবলীলায়। দুজনের ভালবাসার হিল্লোলে আকাশের রক্তকোষের প্রতি অণুতে বিস্তার হতে লাগল মানবজন্মের চেতনার বীজ। এই যেন অন্য এক আকাশ। করুণা নয়, অবহেলা নয়, অনাদরে নয় অতি স্বাভাবিকতায় মর্ত্যের মৃত্তিকা চেয়ে আছে তার দিকে। এটাই যে তার পরম প্রাপ্তি। আজকাল ধর্মীয় ভাবনায় আকাশের নিজস্ব মতামত বেশ প্রাধান্য পায়। সে নামাজ-রোজা কিছুই পালন করে না কিন্তু নৈতিকতা আর যৌক্তিকতা তার জীবনাচরণে স্পষ্টত্ লক্ষণীয়। তার এই নাস্তিক মনোভাব খুব ভাবালো সুজানাকে। এসবের কারণ জানতে চাইলে তার সরাসরি উত্তর সুজানাকে বেশ অবাক করল। আকাশ দৃঢ়স্বরে বলল, “ব্যক্তি প্রয়োজনে জন্মপরিচয়ে যে ধর্ম নির্ধারিত হয়, সেই ধর্ম একজন জন্মপরিচয়হীন মানুষকে স্থান দেবে কি করে?”
“ধর্ম ঠুনকো ব্যাপার নয় তার পবিত্রতায় সবাইকে স্থান দেয়।”
“না। পৃথিবীর সব দেশে আমাদের মত অবাঞ্চিত অনাথ মানুষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মে ফেলা হয়।”
“তবু তো ধর্মের আশ্রয়ে থাকে সে।”
“সব কিছুতেই যখন আমাদের নির্ভর করতে হয় কারো দয়া কিংবা করুনায় তবে ভেতরের অন্তর্নিহিত গূঢ় সত্যের প্রতীক মানবতাই হোক আমাদের ধর্ম। সেখানে নেই কোনো কল্পনার আশ্রয় অথবা পাপস্ঙ্খলনে বিভিন্ন ধারায় নির্ধারিত নানা মতের নানা উপায়। এখানে আছে শুধু যৌক্তিকতা আর নৈতিকতার প্রায়োগিক ব্যবহার।”
“তুমি কি নাস্তিকতাবাদের ইঙ্গিত করছো?”
“তা কেন? আস্তিক হওয়া সোজা কিন্তু নাস্তিক হওয়া কঠিন কারণ সেখানে অদৃশ্য শক্তির উপর সমর্পণ নেই। আছে শুধু যৌক্তিকতার নানা বিন্যাস।”
এই আকাশকে মাঝে মাঝে সুজানার অচেনা লাগে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার মনুষ্যত্বের জ্যোতি তীব্র আকর্ষণ করে সুজানাকে।
সময় গড়াতে লাগলো। এবার মাকে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানালো সুজানা। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এটা যেন কোনো কালেই হবার নয়। অমাবস্যার একাদশীর চাঁদের কলঙ্কের মতো জন্মপরিচয়হীন একটা ছেলেকে স্নেহ করা যায়, করুণা করা যায় আবার প্রশংসার তুঙ্গেও তোলা যায়। কিন্তু একমাত্র মেয়ের স্বামী হিসেবে তাকে কোনোভাবে গ্রহণ করা যায় না। অথচ মাত্র দু’দিন আগেও আকাশ ছিল স্নেহের ধন। কিন্তু স্বার্থের আঘাতে এই ভালোবাসা উড়ে গেল অস্পৃশ্য হাওয়ার শিমুল তুলার মতো। রেগে গেল সুজানা। আকাশকে ছাড়া সে কাউকেই বিয়ে করবে না। মা-মেয়েতে তুমুল অশান্তি চলছে ঘরে। মেয়ের এই জেদীপনায় ভীত হয়ে এক পুরনো কৌশল অবলম্বন করে মা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আকাশকে বিয়ে করলে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে।”
মায়ের এই কথায় সুজানা উভয়সংকটে পড়ল। একদিকে আবেগ অন্যদিকে কর্তব্যবোধ। কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবার মৃত্যুর পর এই মেয়েটাকে বড় করেছে অনেক কষ্টে। তারপর অসময়ে ভাইয়ের মৃত্যুর শোক এখনো মা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। কাজেই সবদিক থেকে বিবেচনা করে কর্তব্যের দায় থেকে সে মায়ের কথা মেনে নিল বুকে পাষান বেঁধে। আকাশকে বুকে ধারণ করেই না হয় বেঁচে থাকবে আজীবন। সময়ের সাথে সাথে আকাশও হয়তো একদিন তাকে ভুলে যাবে। আকাশকে সব খুলে বলল সুজানা এবং সিদ্ধান্ত জানিয়ে অনেক কাঁদল। ম্লান হেসে বলল আকাশ, “যুগের নিষ্ঠুরতা বড় শক্তিশালী। তাকে বাস্তবিক অর্থে বদলানো যায় না।”
বিদায় বেলা কান্না জড়ানো কন্ঠে সুজানা বলেছিল,
“একদিন তুমি মুক্তি চেয়েছিলে, আজ আমি চাইছি। মুক্তিই আমাদের ভবিতব্য।”
এই মুক্তিই আকাশকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে সে নিঃসঙ্গতার মাঝেই আকাশ খুঁজে পেয়েছে তার স্বপ্নযাত্রার ঠিকানা।
নবীনদের একটি প্ল্যাটফর্ম হিজিবিজি। নবীনদের সৃজন, অনুশীলন, বিনোদন, উপার্জন, প্রতিভা প্রদর্শন ও জানার আকর্ষণের মাধ্যম এই প্ল্যাটফর্ম।