ওহে হে মানব জাতি, কেমন আছো? হ্যাঁ জানি, আমি হাসার মতই কথা বলেছি এবং আমি এটাও জানি তোমরা এই মুহূর্তে কি ভাবছো! তোমরা ভাবছো, যে জীবাণুর জন্য গনহারে মরছে মানুষ, সে কিনা সেই মানুষকে জিজ্ঞেস করছে তার স্বাস্থ্যের কথা! কিন্তু কি করবো বলো, আমার উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে যে বলিয়ান। তা তোমরা সুনজর-কুনজর যে নজরেই দেখো না কেন, আমি এই মানবজাতিকে চিরদিনের মতো… না! না! শেষ করে দেব না বরঞ্চ তাদের অভ্যাস-আচরণগুলোকে শুধরে দেব। তার পাশাপাশি তাদের মানবতারও পরীক্ষা নেব। দেখি কতজন শুধরাই আর কতজন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।
২০১৯ সালে আমরা আমাদের লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে এ মানবজাতিকে আক্রমণ করা শুরু করি এবং আমাদের এই প্রজাতি পৃথিবীর রহস্য জালের দুয়ার থেকে আবিষ্কৃত হয়ে উঠে জনমুখে আলোচিত উত্তেজনাপূর্ণ বিষয়। তবে আমি যদি আমার বংশপরিচয়ের কথা তুলি তবে প্রথমেই বলব আমরা প্রায়ই ২০০ প্রজাতির হয়ে থাকি, তার মধ্যে কেবল ৭ প্রজাতিই মানুষকে আক্রমণ করি এবং তাদের মধ্যে এ প্রজাতি খুবই মারাত্মক! এই মাত্র দুই দশক আগে আমাদেরই একটি প্রজাতি তোমাদের কাছে MERS-COV প্রজাতি, চীনে অসোধরানো ৮০০ লোকের প্রাণ কেড়ে নেয়। তা অবশ্য ২০০২-০৩ এর ঘটনা। আমরা প্রায় ১০ হাজার বছর আগে এ পৃথিবীতে এসেছি। বাদুড়ের দেহে থাকতাম তবে তাদের কোন ক্ষতি হতো না।, তবে তাদের দেহ থেকে অন্য প্রাণীর দেহে সংক্রমিত হলে রোগ সৃষ্টি হতো। আমাদের যদি তোমরা ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপে দেখো তাহলে অসাধারণভাবে রাজকীয় তেজী রাজার সম্মানের প্রতীক রাজকীয় মুকুট এর মতো। তাই মুকুট এর প্রতিশব্দ করোনা থেকে আমাদের নামকরণ হয়েছে। লোকমুখে ভয়ঙ্কর হিসেবে পরিচিত হলেও অন্যান্য ভাইরাস থেকে আমাদের ধ্বংস করা খুবই সহজ। অবাক হচ্ছ তো, তবে অবাক হবার কিছু নেই! তোমরা আমাদের সহজেই ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু হ্যাঁ তোমাদের কল্পনা সত্যি হয়েছে। তার মধ্যেও একটা কিন্তু থেকে যায়। তবে সে কিন্তুটা তোমরা যত কঠিন ভাবছো ততটা নয়। আমাদের ধংস করা সহজ কিন্তু তোমরা যদি ঠিকমত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলো, ৭০% অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ঠিকমতো পরিষ্কার করো তবে আমাদের মেমব্রেন গ্লাইকোপ্রোটিন ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আমরা মহাপ্রস্থানের পথে পাড়ি জমাবো। সাবান দিয়ে ধুলে তো আরো ভালো। ঘরের সামান্য সাবান বুদবুদ ফাটিয়ে আমাদের ধ্বংস করতে পারে। আরেকটি জিনিস খেয়াল করো যে, তোমরা মানবজাতি কতখানি সৌভাগ্যবান যে তোমরা যদি ছাই তা কাদামাটি দিয়ে হাত ভালোভাবে ধুলেও আমাদের ক্ষতি হবে যতোটুকু সাবান পানি দিয়ে ধুলে হয়! কিন্তু তোমরা তবুও সতর্ক থাকো না। তোমাদের মানবদেহে আক্রমণ কার্য চালাবার জন্য আমাদের দলের দু-তিন জন সৈনিক কি কাফি! তোমাদের গলায় যখন আমরা অবস্থান করে তখন তোমাদের হাতে থাকে এক সুবর্ণ সুযোগ! তোমরা যদি কুড়ি মিনিট পর পর পানি খাও তাহলে আমরা তোমাদের পাকস্থলীতে চলে যাবো এবং সেখান আছে হাইড্রোক্লোরিক এসিড যা আমাদের ধ্বংস করে ফেলে!তবে যদি আমরা সফলভাবে তোমাদের গলায় চারদিন অবস্থান করার পর ফুসফুসে প্রবেশ করি তখন তোমাদের ফুসফুস আমাদের বংশ পরিচিতি না দেখেই আমাদের মতো লক্ষাধিক সৈনিক প্রস্তুতে নিজের জীবন ঢেলে দেয়। কিন্তু প্রকৃতির কি লীলা! আমাদেরকে আমাদের সৃষ্টিকর্তাকেই ধ্বংস করতে হয়! তবে তার জন্য আমরা দায়ী নই দায়ী তোমরা। তোমরা সতর্ক থাকলে আমরাও আমাদের প্রাণ ত্যাগ করি!তো এই হিসেবে আমার জন্ম। আমি ডি-৬১৪ এর বৈশিষ্ট্যগত একটি সাধারণ নভেল কোভিড-১৯ যা ভাইরাসের সপ্তম বৃহত্তম প্রজাতি। আমি তথা সমগ্র করোনা জাতি গঠিত হই প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিড (একসূত্রক রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বিশিষ্ট) এর মাধ্যমে। এ দুটো মিলে নিউক্লিও ক্যাপসিড প্রোটিন তৈরি করে। আমি আমাদের উৎপত্তির কাহিনী সম্পর্কে আমার বাবার ঠাকুরদার ঠাকুরদা থেকে জেনেছি। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানের BUSHMEAT ( অর্থাৎ খাবারের দোকান) এ একজন একটি সাপকে (যার মধ্যে আমাদের করোনা জাতির প্রতিষ্ঠাতা এবং তার সৃষ্ট কয়েকজন সৈনিক ছিল) ধরে বিক্রি করে এবং একজন সেটাকে সেদ্ধ না করেই জ্যান্ত খেয়ে ফেলে। চিন্তা করো ৫০০ কোটি বয়সী বৃদ্ধ পৃথিবীর মধ্যে আশ্রিত 700 কোটি জনগণের মধ্যে মাত্র একজন, মাত্র একজনের ভুলের জন্য মাত্র সাড়ে ছয় মাসে আমাদের এক ক্রোর মানুকে আক্রমণ করতে হয়েছে! হাজার বছরের যুদ্ধে অর্জিত হাজার লেখকদের লেখায় রচিত বাংলাদেশ আমাদের সংক্রমণ কার্য চালাবার গল্প আজ আমি তোমাদের বলবো।
নয় মাসের যুদ্ধে জেতা ত্রিশ লক্ষ মা- বাবা-ভাই-বোনকে হারিয়ে বিশ্ব বুকে স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীন হবার পর বসে নেই বাঙালি, লড়ছে হাজারো যুদ্ধ।ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রতিদানের কথা মাথায় রেখে ৪৯ বছরের ধারাবাহিকতায় দু-তিন প্রজন্মের বাঙালি চলেছে ৫০,৯৫,৫৩,০০০ বর্গ কিলোমিটারের পৃথিবীর কোনাই কোনাই বাংলাদেশের গৌরব ছড়াতে। হয়তো ভবিষ্যতেও এ মহান উদ্দেশ্য অব্যাহত থাকবে। সে হিসেবে একজন বাঙালি এ মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিল ইতালি। সেখানে একজনের দেহে আমার ঠাকুরদার সংক্রমণ কার্য চালাচ্ছিলেন। সে নরদেহের ফুসফুসে আমার বাবার জন্ম। সে ব্যক্তি ছিল খুবই দুর্বল এবং তা আমার ঠাকুর্দা বুঝতে পেরে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগেই আমার বাবাকে নিয়ে চলে আসে। তখন তারা সে বাঙালির আশে পাশেই ছিল। তারপর আমার ঠাকুরদা জানতে পারল,তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই জায়গার অবস্থা খারাপ বলে তিনি বাংলাদেশে চলে যাবেন। তিনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং তিনি যখন যাবেন তখন তিনি সাধারণ সার্জিক্যাল মাক্স পড়েছেন তাও পুরাতন! তার একটি ফাঁক দিয়ে সে বাঙালি প্রশ্বাসের সাথে গলায় প্রবেশ করে আমার বাবা ও ঠাকুরদা। তারপর ৮ ই মার্চ টোলারবাগ, মিরপুর,ঢাকায় বাংলাদেশে প্রথম আমাদের সংক্রমণ শুরু হয়। সেদিন হতে বাংলাদেশে মাত্র একশ তিন দিনে এক লক্ষ মানুষ আমাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে! সেখানেই উনার ফুসফুসের মাধ্যমে আমার জন্ম। এরই মধ্যে এক খুশির বার্তা সারাদেশে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ল। প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে আরেকজন আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু ১২ ই মার্চ দু’জনই পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিল। সে দুজন দেশকে করোনা মুক্ত রাখার অদম্য ইচ্ছার বলে চিকিৎসকদের সেবা গ্রহণ করে, নিজে সতর্ক থেকে সুস্থ হয়ে ছিল মাত্র চারদিনে। আমার জন্ম মুহূর্ত থেকে আমার কাজ শুরু। বাঙ্গালী ভদ্রলোক হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু ব্যবহার করত। উনার ব্যবহৃত ১৯৩ তম টিস্যুতে উনার হাঁচির সাথে আমি এবং আমার সহিত নবজাতক ৬০ জন সৈনিক আটকা পড়ি! একজন স্বেচ্ছাসেবী চীন প্রদত্ত একজোড়া গ্লাভস পড়ে ডাস্টবিনটি পরিস্কার করছিল এবং ভুলবশত বাঙ্গালী ভদ্রলোকের ব্যবহৃত ১৭১ তম ও ১৯৩ তম টিস্যুটি আর হাতে লেগে যায় এবং আমরা সকলের টিস্যুর বদলে গ্লাভসে আটকা পড়ি! আমরা সেখানে জানতে পারি ভদ্রলোকের ব্যবহৃত ১৯৩ তম টিস্যু হতে আমরা 61 জন সৈনিক এর সাথে যোগ হয়েছে উনার ব্যবহৃত ১৭১ তম ১৩৩ জন সৈনিক। ওই স্বেচ্ছাসেবী গ্লাভস পরে টিস্যুগুলোকে ফেলে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেও কিছু মুহূর্ত পরপরই তিনি এক চরম বোকামির কাজ করলেন! আমরা যে গ্লাভসে আটকা ছিলাম,সে গ্লাভস টি তিনি রাস্তায় ফেলে দিলেন। সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন এক পথিক। তিনি তার পিপাসা মেটানোর জন্য জলের বোতল বের করল। কিন্তু ভুলবশত সেটি নিচে পড়ে যায় এবং গ্লাভস গুলোর সাথে লেগে কিছুদূর গড়িয়ে যায়। সে ব্যক্তি সেটি নীচ থেকে তুলে এবং আমরা সকলে বোতল থেকে সোজা তার হাতে এসে পড়ি। সেখানের ঘটনা থেকে সেও আমাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এই ঘটনার পর আমার দ্বারা আক্রান্ত হবার অনেক ঘটনা আছে যেগুলো বললে ৪০০ পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে! আর তোমরা তো অসীম গুণধর অপরিচিত মানুষের মূল্যের ম টাও দাও না, তাহলে আমার অর্থাৎ 1.3 মাইক্রোমিটার এর একটি ভাইরাসের অনেক পৃষ্ঠার আত্মকাহিনী কেন লিখবেন যাও কিনা মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়! তাই এটি চার পৃষ্ঠার গল্প হয়েই থাক।
বিগত দু’লক্ষ বছরে বিকশিত হয়েছে তোমরা। কখনো তোমরা প্রকৃতির কাছ থেকে জীবনের সম্বলটুকু থেকে এতটুকুও বঞ্চিত হওনি। তবুও তোমরা চালিয়ে যাচ্ছ নির্বোধ নির্যাতন সে মমতাময়ী প্রকৃতি মায়ের বিরুদ্ধে! বিধাতা তোমাদের কত বড় ক্ষমতা দিয়েছে, একবার চিন্তা কর! লক্ষ লক্ষ জাতের জীবের মধ্যে একমাত্র তোমরা মানুষরাই এই ক্ষমতা ও দায়িত্ব পেয়েছ আমাদের মতো কত ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া,কত প্রাণী কতো উদ্ভিদের মধ্যে। এত ভাগ্যবান হয়েও নিজের ভাগ্যকে অস্বীকার করলে! হায়, এত নির্বুদ্ধিতার পরও বল যে তোমরা সবচেয়ে বুদ্ধিমান, হা হা হা! শেষমেষ তোমাদের বলে দিচ্ছি,প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে কিন্তু কেউ বাঁচেনি আর বাঁচতেও পারবে না! কে বলতে পারবে,যে ২৯ ভাগ জমিন নিয়ে তোমরা অসন্তুষ্ট তাও যদি একদিন পায়ের তলা থেকে সরে যায়!৩৪ কোটি বর্গকিলোমিটার জলের এক ফোঁটাও না থাকে ! বায়ুমণ্ডলের ৪২.৭ শতাংশ অক্সিজেন এর মধ্যে এক চুল পরিমাণও না থাকে! তাই অন্তত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রকৃতির প্রতি একটু সহনশীল হও। না হলে প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত থেকো। মনে রেখো, আমাদের মতো সহস্ত্র মহামারি-দুর্যোগও কিন্তু আসন্ন!
নবীনদের একটি প্ল্যাটফর্ম হিজিবিজি। নবীনদের সৃজন, অনুশীলন, বিনোদন, উপার্জন, প্রতিভা প্রদর্শন ও জানার আকর্ষণের মাধ্যম এই প্ল্যাটফর্ম।